ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নাটোরের জীবন্ত মৎস পরিবহন পদ্ধতি

শহীদুল হক সরদার, নাটোর | প্রকাশিত: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০১:০১; আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:২৭

ট্রাকে করে সারা বাংলাদেশ নেয়া হয় জীবন্ত মাছ

নাটোর অঞ্চল থেকে প্রতিদিন প্রায় আড়াইশ পানি ভর্তি ট্রাকে জীবন্ত মাছ যায় ঢাকা, চট্রগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। এই নতুন উদ্ভাবনে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে নাটোরের মৎস্য অঙ্গন। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঐসব মাছ রাখা হচ্ছে জীবন্ত। ক্রেতাদের হাতে ফরমালিন মুক্ত জীবন্ত মাছ পৌঁছে দেওয়ার এই প্রযুক্তি পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। মাছ চাষ, জলাশয় রক্ষণাবেক্ষন, মাছ ধরা ও বাজারজাত করার মাধ্যমে শুধুমাত্র নাটোর জেলাতেই ৪৫হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য বিভাগ।

নাটোর জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নতুন প্রযুক্তিতে পুকুর আর দীঘি থেকে আহরিত রুই জাতীয় মাছ অনেকটা সময় জালের মধ্যে পানিতেই রাখা হয়। মাছের পেটের খাবার শেষ হলে পানি থেকে বড় হাঁড়িতে করে পর্যায়ক্রমে নিয়ে যাওয়া হয় পানি ভর্তি ট্রাকে। এসব ট্রাক নাটোর থেকে চলে যায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ চট্রগ্রাম ও সিলেটে।

মোটা পলিথিন, স্টিলের পাত অথবা ত্রিপলে আচ্ছাদিত পানি ভর্তি ট্রাকের মাথার উপরে বসানো শ্যালো মেশিনে ঐ পানিই চক্রাকারে প্রবাহিত করা হচ্ছে ট্রাকের মধ্যে। উদ্দেশ্য পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ ঠিক রেখে মাছগুলোকে জীবন্ত রাখা।

জেলায় রুই জাতীয় মাছের মৎস্য ভান্ডার খ্যাত গুরুদাসপুর উপজেলার মহারাজপুর, চাপিলা আর বড়াইগ্রাম উপজেলার মৌখাড়া এলাকাতে মৎস্য চাষীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে এই প্রযুক্তির উদ্ভাবন করলেও এখন ছড়িয়ে পড়েছে অবশিষ্ট পাঁচটি উপজেলাতেও।

২০০৬ সালের দিকে মাছে ফরমালিন ব্যবহারের বিষয়টি ছিলো ব্যাপক আলোচিত। তখন নাটোরের মৎস্য চাষীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে স্থানীয় বাহনে পানির আধার তৈরী করে শ্যালো মেশিনে আবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাছ নেয়া শুরু হয় সিরাজগঞ্জের মহিষলুটি মাছের আড়তে। ঐ আড়তে আসা ঢাকার পাইকারী ক্রেতারা জীবন্ত মাছ দেখে অভিভূত হন। পরবর্তীতে যমুনা ব্রীজ পার হয়ে মাছ নিয়ে যাওয়া শুরু হয় সরাসরি ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে।

বড়াইগ্রাম উপজেলার মৌখাড়া এলাকার মৎস্য চাষী মতিউর রহমান সুমন জানান, মৌখাড়া আর চাপিলা-মহারাজপুরের মৎস্য চাষীরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে নতুন এই প্রযুক্তির প্রবর্তন করেছেন। এখন এই প্রযুক্তি সারা জেলাসহ রাজশাহীর পুঠিয়া, বাগমারা ও তাহেরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলাতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

তিনি আরো বলেন, মাছ চাষের মাধ্যমে মাওয়া ফেরীঘাট আড়তে আমাদের পাঠানো গড়ে দুই কেজি ওজনের এক হালি রুই মাছ বিক্রি হয় ষোলশ’ থেকে আঠারশ’ টাকা দরে। এছাড়া ঢাকার যাত্রাবাড়ি, বাড্ডা, মীরপুর, নিউমার্কেট, ফুলবাড়ি, কালিয়াকৈড় ছাড়াও চট্রগ্রাম এবং সিলেটেও জীবন্ত মাছের ট্রাক যায়।

বড়াইগ্রাম পৌরসভার মেয়র মাজেদুল বারী নয়নও একজন মৎস্য চাষী। তিনি বলেন, জীবন্ত মাছের বাজার সৃষ্টির ফলে এলাকাতে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়েছে। আমরা মাছ চাষে অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিক রাখতে পানিতে বিদ্যুৎ সংযোগসহ ছোট্র মেশিন এরেটরসহ নতুন নতুন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছি। পানির স্তর বিবেচনায় রকমারী মাছ চাষ করছি।

নাটোর শহর এলাকার মৎস্য চাষী শিক্ষক আব্দুস সালাম ও জিয়াউল করিম বেলাল জানান, শহরের দিয়ারভিটা এলাকায় তারা সাতজন মিলে ৩৩ বিঘা পুকুর লিজ নিয়ে বড় পরিসরে মাছ চাষ করছেন। লিজ, পোনা ক্রয়, মাছের খাবার ও শ্রমিক খরচসহ বছরে তাদের খরচ হয়েছে ৪৬ লাখ টাকা। প্রথম বছরে তাদের এই প্রকল্পে কোন লাভ না হলেও দেশের মানুষকে স্বাদু পানির ফরমালিনমুক্ত মাছ খাওয়াতে পারছেন এটাই তাদের প্রশান্তি। এবার না হোক পরের বার লাভ হবে বলে তারা আশা করেন।

নাটোর জেলা মৎস্য জরীপ কর্মকর্তা এস এম নাজিম উদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলেন, নাটোরে মৎস্য চাষের মাধ্যমে জেলায় প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরী হয়েছে।

তিনি বলেন প্রতিদিন শুধু নাটোর জেলা থেকে গড়ে দেড় শতাধিক জীবন্ত মাছের ট্রাক যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। প্রত্যেক ট্রাকে ৬০০ থেকে ৮০০ কেজি মাছ থাকে। এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নাটোরে মাছ চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বিভাগের অধ্যাপক দেশের অন্যতম মৎস্য বিজ্ঞানী আখতার হোসেন বলেছেন, ১৯৯৯ সালে তিনি একটি গবেষণার পর খরাপ্রবণ নাটোর, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া অঞ্চলের পানির সমস্যার কারণে মৎস্যচাষীদের পুকুরে পোনা মাছ না ছেড়ে একশ গ্রামের উপরের ওজনের মাছ ছাড়ার জন্য পরামর্শ দেন। প্রথমে না মানলেও চাষীরা এই পরামর্শ মানার পর থেকেই এ অঞ্চলে মৎস্যচাষে বিপ্লব ঘটে গেছে। দেশের মানুষ বিষমুক্ত জীবন্ত মাছ খেতে পারছে।

নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নাটোর জেলায় মাছের বাৎসরিক চাহিদা ৩৪ হাজার ৩৭৬ টনের বিপরীতে মাছ উৎপাদন হচ্ছে ৬৬ হাজার ৯৩৪ টন। অর্থাৎ উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকের বেশি উদ্বৃত্ত। এই উৎপাদনের মধ্যে জেলার ২৭ হাজার ৬৪০টি পুকুর ও দীঘির মাছের পরিমাণ ৪৭ হাজার ২৫১ টন। জেলা থেকে প্রায় ৩২ হাজার ৫৫৮ মেট্রিক টন রুই জাতীয় মাছ প্রতি বছর ঢাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে যাচ্ছে।

 



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top