বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন: জীববৈচিত্র্য সংকট ও ভবিষ্যৎ পৃথিবী
মোঃ রোকনুজ্জামান | প্রকাশিত: ৩১ জানুয়ারী ২০২৫ ২১:৫৬; আপডেট: ৩১ জানুয়ারী ২০২৫ ২১:৫৯

বর্তমান সময়ের অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক ও উন্নত বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি ব্যাপক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি বর্তমানে এতটাই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আগামী কয়েক শতাব্দীতে এই পৃথিবীতে অনেক বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে যা মানুষের বসবাসের এই পৃথিবীতে করে তুলবে বসবাসের অযোগ্য।
বর্তমান এই শতাব্দীতে নতুন কিছু পাওয়ার আশায় পৃথিবীর মানুষ। সময়ের আবর্তনে মানুষের এমন চাহিদা অমূলক নয়। কিন্তু সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে একটি ব্যাপারে পুরো বিশ্ব আজ সরব।
সবখানে একটিই কথা একটিই আলোচনা তাহলো " জলবায়ু পরিবর্তন" জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে আর একটা বিষয় জড়িত তাহলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্যর সংকট বর্তমান আধুনিক যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন একটি স্থানের কয়েক বছরের আবহাওয়ার গড় পড়তা যে ধরণ তাই হচ্ছে ঐ স্থানের জলবায়ু। কিন্তু বর্তমান সময়ে আবহাওয়ার সেই চেনাজানা ধরণে পরিবর্তন হওয়াকে ই বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আবহাওয়ার বহুদিনের চেনাজানা আচরণ দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন কেন এই শতাব্দীতে এক আতঙ্কের বিষয়?
জলবায়ু পরিবর্তন এই শতাব্দীতে একটি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এটি মানুষের জীবন যাপন, প্রকৃতি, এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব মানুষের জীবনযাত্রার ওপর সরাসরি পড়বে । জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) 'র তথ্য অনুযায়ী বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে যা গ্লোবাল ওয়ার্মিং সৃষ্টি করছে।
এছাড়াও (IPCC)'র তথ্য অনুযায়ী গত শতাব্দীর তুলনায় বর্তমান শতাব্দীতে তাপমাত্রা ১.৫° সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।এই উষ্ণায়ন মূলত মানবসৃষ্ট গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমনের ফলে ঘটেছে। এছাড়া IPCC'র ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে যদি গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকে তবে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরো বৃদ্ধি পাবে।
ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে।এবং এর ফলে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে,এই অবস্থা চলতে থাকলে পৃথিবীতে কৃত্রিম পানির সংকট তৈরি হবে, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। ধীরে ধীরে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে কোনো কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা অনেক বেশি হয়ে পড়বে এবং সেই সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে অনেক অঞ্চল প্লাবিত হবে।ফলে সে সব স্থান মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে উত্তর মেরুর জমাটবাঁধা বরফ এবং হিমবাহ দ্রুত গলে যাচ্ছে।ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে উপকূলের নিচু এলাকা গুলো পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। সাইবেরিয়ার মরুময় অঞ্চলের মাটিতে জমে থাকা বরফ গলতে থাকায় বরফের নীচে থাকা মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে।ফলে মিথেনের মত আরেকটি গ্রীন হাউজ গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বাড়িয়ে দিবে।
ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবে এবং বন-জঙ্গলে আগুন লাগার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য এক মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে। প্রকৃতি তাদের চির চেনা বাসস্থানের আবহাওয়ার পরিবর্তনের জেরে অনেক প্রাণী নতুন স্থানে চলে যাবে। জলবায়ুর পরিবর্তন এতই দ্রুত হারে চলছে যে, অনেক প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।যেমন উত্তর মেরুর বরফ গলতে থাকায় পোলার বিয়ার বা উত্তর মেরুর শ্বেত ভল্লুকের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
এছাড়া ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, এবং দাবানলের মতো দুর্যোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস এঞ্জেলেস এর ভয়াবহ দাবানল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ যা মানবসম্পদ এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।এইসব বৈরিতার কারণে ধীরে ধীরে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়েছে যা বাস্তূসংস্থানের ভারসাম্য নষ্ট করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং পানির উৎস সংকুচিত হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে যা জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরিতার দিকেই ইঙ্গিত দেয়।
জলবায়ুর এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী কি?
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় গুলোর মধ্যে হলো জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন এবং শিল্পে কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার এছাড়াও বৃক্ষ নিধনের ফলে কার্বন শোষণের মাত্রা হ্রাস পাচ্ছে, শিল্প কারখানা থেকে দূষক নির্গমন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, প্লাস্টিক দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় ও খনিজ আহরণ উল্লেখযোগ্য।
তাই আগামীর পৃথিবীকে বাসযোগ্য ও নিরাপদ করতে হলে আমাদের সবাইকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সচেষ্ট হতে হবে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্যর সংকট গুরুতর হলেও সঠিক পদক্ষেপ এবং কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে এর সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। যেমন নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।এছাড়া কার্বণ শোষণের জন্য বেশি বেশি বৃক্ষ রোপন করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।
এজন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও অভয়ারণ্য স্থাপন করা,টেকসই বন ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণা ও শিক্ষার প্রসার করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে গবেষণা বৃদ্ধি করা এবং মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক এই চ্যালেঞ্জ কে মোকাবেলা করতে হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে উদ্দ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।সেই সাথে আগামীর পৃথিবীকে একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব শিল্প ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে ।
লেখক: মোঃ রোকনুজ্জামান শিক্ষার্থী, ডক্টর অফ ভেটেরিনারি মেডিসিন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: