নির্মম নির্যাতন

‘দুই কোটি টাকা দে, নইলে ছেলের লাশও পাবি না’

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারী ২০২৪ ০৮:৩৮; আপডেট: ২০ মে ২০২৪ ০৯:১৮

ছবি: সংগৃহীত

‘তোকে সকাল ৬টার মধ্যে ২ কোটি টাকা পাঠাতে বলেছি, আমার লোক দাঁড়িয়ে ছিল, এখনো দিলি না। প্রশাসনকে জানাইছিস! এবার টাকা দে, নইলে ছেলের হাত কেটে তোকে পাঠাচ্ছি’—এটা মুভির ট্রেলার...। ‘টাকা দে, নইলে লাশও পাবি না।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে এক নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার বাচ্চাটা নিষ্পাপ। আপনার তো টাকা দরকার। ছেলেকে কেন মারবেন?’

পুরুষ কণ্ঠে বলা হয়, ‘প্রশাসনরে জানাইসছ তো, এখন তোর বাবার থার্ড ডিগ্রি শুরু হবে। সন্ধ্যার পর তুই টের পাবি।’ নারী কণ্ঠ থেকে বলা হয়, ‘আমার ছেলেকে খুন করে কী হবে, ব্যাংক থেকে এত টাকা দিচ্ছে না, আপনি অ্যাকাউন্ট নম্বর দেন, টাকা ট্রান্সফার করে দিচ্ছি।’

উপরের কথোপকথন রাজধানীর উত্তরার ব্যবসায়ী কাজী হাবিবুর রহমানের স্ত্রী তহুরা বিনতে হকের সঙ্গে এক অপহরণকারীর। ২৬ ডিসেম্বর তার একমাত্র সন্তান কাজী হাসিবুর রহমান হিমেলকে (২৫) অপহরণের পর এভাবেই মুক্তিপণ চায় অপহরণকারীরা।

হিমেল উত্তরার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চার মাস আগে তার বাবা মারা যাওয়ার পর পারিবারিক ব্যবসা দেখভাল শুরু করেন তিনি। ‘সাউথ-চায়না ইন্টারন্যাশনাল’ নামে তাদের ব্যাটারি প্রস্তুতের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অপহৃত হিমেলকে গতকাল বুধবার রাতে র্যাবের একটি দল সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে উদ্ধার করেছে।

সূত্র জানায়, হিমেলকে উত্তরা থেকে অপহরণের পর ময়মনসিংহের একটি বাড়িতে দুদিন আটকে রাখা হয়। এরপর তাকে সীমান্ত দিয়ে মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকেই হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে হিমেলের মায়ের কাছে টাকা দাবি করা হয়। এই অপহরণের মূলহোতা ময়মনসিংহের শীর্ষ সন্ত্রাসী আব্দুল মালেক। মেঘালয়ে তার আস্তানা রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, অপহরণের ঘটনা জানার পর থেকেই ডিবির টিম ছায়াতদন্ত শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় অপহরণে জড়িত সুনামগঞ্জের তাহিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হিমেলকে অপহরণের পর তাকে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। সেই ভিডিও তার মায়ের কাছে পাঠানো হয়। ডিবির পক্ষ থেকে মেঘালয় পুলিশের সহায়তা চাওয়া হলে স্থানীয় পুলিশ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মেঘালয় এলাকায় অভিযান শুরু করে মালেকের আস্তানা পায়। পুলিশের ধাওয়ার মুখে অপহরণকারী সীমান্ত পেরিয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও মধ্যনগর দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। এরপর সুনামগঞ্জ পুলিশের সহায়তায় ডিবি পাঁচ অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনাস্থলে র্যাব অভিযানে গেলে তারা দুজন অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করে।

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অপহৃত হাসিবুর রহমান হিমেলকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে উদ্ধার করেছেন তারা। তাকে অপহরণ করে পাশবিক কায়দায় নির্যাতন ও মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় মূলহোত মালেকসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী হিমেলের গাড়িচালক সামিদুল। সে অপহরণকারী মালেককে জানায় যে, বাবা মারা যাওয়ার পর হিমেল এখন সব সম্পত্তির মালিক। এরপর উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় অপহরণ পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা বৈঠকে মালেক ছাড়াও তার স্ত্রী কামরুন নাহার, সামিদুল ও তার স্ত্রী রুবিনা ছিল। ওই দুই নারী ছাড়াও মানিক ও মোবারক নামে আরও দুজনকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মামুন নামে অপহরণ চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায়। সে একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়।

এ ঘটনায় করা মামলাটির তদন্ত করছে ডিবির লালবাগ বিভাগ। ওই বিভাগের ডিসি (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, অপহরণের মূলহোতা আবদুল মালেক একজন সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে অপহরণ, চাঁদাবাজি, পুলিশ সদস্যকে লক্ষ্য করে গুলিসহ নানা অভিযোগে অন্তত ১৭টি মামলা রয়েছে।

হিমেলের মায়ের কাছে অপহরণকারীদের পাঠানো ভিডিওর একটিতে দেখা যায়, হিমেলকে পেছন থেকে গামছা দিয়ে হাত, কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। তার পরনেও একটি গামছা। তাকে পাহাড়ি এলাকার মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে, পুরো শরীরে নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হিমেলকে উল্টো করে একটি গাছের সঙ্গে পা বেঁধে টানানো হয়েছে। ওই অবস্থায় তাকে একজন বেধড়ক পেটাচ্ছে। হিমেল বলছেন, ‘মা, মা আমাকে বাঁচাও। মা, ও মা...।’

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, অপহরণকারীদের একজন হিমেলের গলা চেপে ধরে মাটিয়ে ফেলে রেখেছে। আরেকজন তাকে নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছে। হিমেল রক্ষা পেতে করুণ চিৎকার করছেন। ওই ভিডিওতে পুলিশ প্রশাসনকে অপহরণকারীরা গালাগাল করতে শোনা যায়। আরেক ভিডিওতে হিমেলের হাত-পা বেঁধে একটি গাছের সঙ্গে টানিয়ে নিষ্ঠুরভাবে পেটাতে দেখা যায়। তখন হিমেল করুণভাবে বলছিলেন, ‘মা তোমার পায়ে ধরি, মা তুমি প্রশাসনের লোকদের হেল্প নিও না। তোমারে এই ভদ্রলোক যে জায়গায় বলে, সেখানে টাকা এনে দাও মা...।’

অপহরণের বিবরণ দিয়ে ডিবি কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, হিমেল ঘটনার দিন পারিবারিক ব্যবসার প্রয়োজনে নিজস্ব প্রাইভেটকারে চালক সামিদুলকে নিয়ে উত্তরার বাসা থেকে শেরপুরের উদ্দেশে বের হন। ওইদিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পরিবারের পক্ষ থেকে উত্তরা পশ্চিম থানায় জিডি করা হয়। এরই মধ্যে একাধিক ভারতীয় মোবাইল নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে হিমেলের মাকে ফোন দিয়ে মুক্তিপণের ২ কোটি টাকা দাবি করে অপহরণকারীরা। পরে তা কমে ১ কোটি ও পরে ৩০ লাখ টাকায় নামে।

ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, হিমেলের অবস্থান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি এলাকায় নিশ্চিত হয়ে সেখানকার পুলিশকে দিয়ে মেঘালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম খাসি হিলস জেলার ননগ্লাম থানার পাহাড়িয়া এলাকায় অভিযান চালানো হয়। তখন ধাওয়ার মুখে অপহরণকারীরা হিমেলকে নিয়ে তাহিরপুর সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করে।

খবর পেয়ে ডিবি পুলিশের রিকুইজিশনের প্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা স্থানীয় জনতার সহযোগিতায় অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করে। অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে সিলেট অঞ্চলের র্যাব সদস্যরাও উপস্থিত হন। তারা আসামি মালেক এবং সামিদুলকে নিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ভিকটিমকে উদ্ধার করে।

তথ্যসূত্র: দৈনিক কালবেলা 




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top