নিয়ম ভেঙে প্রভাবশালীদের পছন্দে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিল রাজউক

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৩ আগস্ট ২০২২ ১৮:০৪; আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ২০:৩৪

ছবি: সংগৃহিত

নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রভাবশালীদের পছন্দমতো উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে ফ্ল্যাট বরাদ্দের অভিযোগ উঠেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিরুদ্ধে। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে অন্তত ৩০৪টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর পেছনে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তদবির ও আর্থিক অনিয়ম রয়েছে বলে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন। খবর প্রথম আলো

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ৩০৪টি ফ্ল্যাট যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই লটারির মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় একটি ফ্ল্যাট পেয়েছিলেন। পরে ফ্ল্যাটের কাজ বা অবস্থান পছন্দ না হওয়ায় তদবির করে ফ্ল্যাট পরিবর্তন করে বিভিন্ন ভবনে পছন্দমতো ফ্ল্যাট নিয়েছেন। তাঁরা আগের চেয়ে তুলনামূলক ভালো জায়গায় ফ্ল্যাট পেয়েছেন। নতুন করে পাওয়া ফ্ল্যাটের বেশির ভাগই লেকের পাশে, দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্বমুখী।

অভিযোগ উঠেছে, রাজউকে ২০১৮ সালের পর এই অনিয়ম শুরু হয়েছে। গত এপ্রিলে সর্বশেষ লটারি ছাড়া ফ্ল্যাট বরাদ্দের অনিয়মটি হয়েছে। ওই মাসে রাজউকের বোর্ড সভায় লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ পাওয়া ফ্ল্যাট ফেরত দিয়ে নতুন করে পছন্দমতো ফ্ল্যাটের আইডি (ভবনে ফ্ল্যাটের অবস্থান) উল্লেখ করে ২৪ জন আবেদন করেন। এর মধ্যে ১টি ছাড়া ২৩টি ফ্ল্যাটের আইডি পরিবর্তন করে নতুন ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়েছে রাজউকের বোর্ড।

পরে ২০২০ সালে রাজউকের আরেক বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, ফ্ল্যাটের দখল হস্তান্তরের পর সেই ফ্ল্যাট আর পরিবর্তন করা যাবে না।

ফ্ল্যাটের আইডি বা অবস্থান পরিবর্তনকে অনিয়ম হিসেবে দেখছেন কি না বা এর মাধ্যমে অন্যদের বঞ্চিত করা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো ফ্ল্যাটের আইডি পরিবর্তন করা হয়নি। কী কারণে বা কেন আইডি পরিবর্তন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে নথিপত্র না দেখে তিনি মন্তব্য করতে পারবেন না।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে একইভাবে আরও ২৮১টি ফ্ল্যাট লটারি ছাড়াই বরাদ্দ দিয়েছিল রাজউক। ২০২০ সালে ‘গোপনে ২৮১ ফ্ল্যাট বরাদ্দ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। এরপর বেশ কিছুদিন রাজউকের এই অনিয়ম বন্ধ ছিল। সম্প্রতি আবার সেটি শুরু হয়েছে।

রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পটি (১৮ নম্বর সেক্টর) শুরু হয়। ‘নিম্ন ও মধ্যম’ আয়ের মানুষের জন্য এই প্রকল্প নেওয়া হলেও প্রকল্প এলাকায় ফ্ল্যাটের দাম এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যা নিম্নবিত্তের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই প্রকল্পে ৭৯টি ১৬ তলা ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি ভবনের নির্মাণকাজ এখনো চলছে। সব ভবন মিলে মোট ফ্ল্যাট ৬ হাজার ৬৩৬টি। এর মধ্যে প্রায় ৭০০ ফ্ল্যাট এখনো অবিক্রীত রয়ে গেছে।

জানা গেছে, ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য গণমাধ্যম ও রাজউকের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদনপত্র আহ্বান করে রাজউক। আগ্রহী গ্রাহকদের আবেদনের পর সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর যোগ্য ব্যক্তিদের সাময়িক একটি বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়। তবে সাময়িক বরাদ্দপত্রে কে কোন ভবনের কত নম্বর ফ্ল্যাট পেলেন, তার উল্লেখ থাকে না। বরাদ্দপত্র পেলেই চার কিস্তির টাকা (ফ্ল্যাটের মোট দামের প্রায় অর্ধেক) পরিশোধ করতে হয়। এরপর লটারির মাধ্যমে আবেদনকারীকে ফ্ল্যাট আইডি (ভবন ও ফ্ল্যাটের নম্বর) দেওয়া হয়। রাজউকের বোর্ডে পাসের পর চূড়ান্ত বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়।

২০১৮ সাল পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া মেনে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ৪ হাজার ২৯৮টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপরই অনিয়ম শুরু হয় বলে অভিযোগ ওঠে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে লটারির মাধ্যমে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়া একজন অভিযোগ করেন, তিনি লটারির মাধ্যমে নিচতলায় একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন। সবকিছু স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হচ্ছে ভেবে তিনি নিজের ভাগ্যকে মেনে নেন। কিন্তু তদবিরের মাধ্যমে রাজউক অন্যদের পছন্দমতো ফ্ল্যাট দিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

সর্বশেষ গত এপ্রিলে রাজউকের বোর্ড সভায় ওঠা ফ্ল্যাটের আইডি পরিবর্তনসংক্রান্ত ২৪টি আবেদনের প্রথমটি ছিল একজন চিকিৎসকের। তিনি লটারির মাধ্যমে ১৫ সি নম্বর ভবনের ১০৩ নম্বর ফ্ল্যাটটি বরাদ্দ পান। পরে তিনি রাজউকে আবেদন করে এই ফ্ল্যাট পরিবর্তন করে তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম তলায় দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্বমুখী একটি ফ্ল্যাট চান। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক তাঁকে ১৫ বি নম্বর ভবনের ১০ তলায় নতুন করে আরেকটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়।

এ ছাড়া গত এপ্রিলে বোর্ড সভায় লটারি ছাড়াই নতুন করে ফ্ল্যাট পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন মো. জোনাব উদ্দিন, বিশ্বনাথ পাল, এস এম আবু আদনান আবির ও মো. হাবিবুর রহমান। জোনাব এ-ব্লকের ৮এ ভবনের ১০৪ নম্বর ফ্ল্যাটের বদলে ৬এ ভবনের ১৩০২ (১৩ তলায়) নম্বর, বিশ্বনাথ পাল এ-ব্লকের ১৩সি ভবনের ৬০৪ নম্বর ফ্ল্যাটের বদলে ১০সি ভবনের ৫০৩ নম্বর, আবু আদনান ১৭বি ভবনের ১০১ নম্বর ফ্ল্যাটের বদলে ২০৩ নম্বর ফ্ল্যাট এবং হাবিবুর ১৭বি ভবনের ৭০৪ নম্বর ফ্ল্যাটের বদলে ১০বি ভবনের ৮০৬ নম্বর ফ্ল্যাট পান।

রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-১) মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মূল শহর থেকে দূরে হওয়ায় ফ্ল্যাট পছন্দ না হলে অনেকে টাকা ফেরত নিয়ে যান, এতে রাজউকের ক্ষতি হয়।

তাই লটারির মাধ্যমে পাওয়ার পর কারও ফ্ল্যাট পছন্দ না হলে রাজউকে তিনি পরিবতর্নের আবেদন করেন। বোর্ড চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। যাঁদের ফ্ল্যাট পরিবর্তন করা হয়েছে, তাঁদের কেউ ওই সব ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেননি। বসবাস শুরু না করলে রাজউক এ সুবিধা দিচ্ছে।

উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প মালিক সমিতির সভাপতি হামিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, একই বিষয়ে দুই নীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। লটারির মাধ্যমে ফ্ল্যাটের বরাদ্দ দেওয়া সবার জন্যই প্রযোজ্য। প্রকল্প এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ ফ্ল্যাট এভাবেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তদবির করে বা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ফ্ল্যাটের আইডি পরিবর্তন করলে সেটি নিয়মের ব্যত্যয় এবং এটি অপরাধ।

খবরের লিঙ্ক



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top