ডেঙ্গু চিকিৎসা: ‘ডেডিকেটেড’ হাসপাতালেই নানা সংকট

রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ১৮ জুলাই ২০২৩ ১৬:১৮; আপডেট: ১৪ মে ২০২৪ ১৭:৫৪

ছবি: সংগৃহীত

দেশজুড়ে হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। রাজধানীর গণ্ডি ছাড়িয়ে ইতোমধ্যেই মশাবাহিত রোগটির প্রকোপ ছড়িয়েছে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায়। সবশেষ সরকারি হিসেব বলছে- চলতি বছরে এখন পর্যন্ত এডিস মশাবাহী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১১৪ জনের প্রাণ ঝরেছে। যারমধ্যে বড় একটি অংশ শিশু। খবর ঢাকা মেইলের। 

এদিকে, মশাবাহিত রোগটির সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতেও। ডেঙ্গু নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী হাসপাতালে আসায় সেবা দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলোয় রোগীদের চাপ অনেক বেশি।

এই অবস্থায় করোনা মহামারিকালে স্থাপিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কোভিড হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা করেছে সরকার। গত ১২ জুলাই এই ঘোষণার পরপরই এখানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি শুরু হয়েছে। তবে প্রথম দিকে এখানে রোগীরা তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হলেও চাপ বাড়ার সঙ্গে নানা সমস্যা সামনে আসছে। Special-Report রোগীদের অভিযোগ- হাসপাতালটিতে সেবার মান ভালো হলেও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ঘাটতি রয়েছে। ফলে রোগীদের সেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে ডেঙ্গু সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য রোগীর স্বজনদের দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। এমনকি হাসপাতালটির বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ভর্তি না করারও অভিযোগ রয়েছে।

যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি- স্বল্প সময়ের নোটিশে সেবা চালু হওয়ায় জনবল সংকটসহ বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। তবে তা সহসায় কেটে যাবে বলেও দাবি তাদের।

নার্স সংকট ও পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা

সরেজমিনে ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতাল ভবনের তিন তলায় মহিলা ও চার তলায় পুরুষদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড রয়েছে। সেখানে প্রতিটি ওয়ার্ডে দুইজন নার্স এবং চিকিৎসক সার্বক্ষণিক সেবা দিচ্ছেন। এরমধ্যে চিকিৎসকরা নির্দিষ্ট রাউন্ড ছাড়াও প্রয়োজনে ওয়ার্ডে এসে রোগী দেখে যাচ্ছেন।

অপরদিকে কর্তব্যরত নার্সরাও রোগীদের নিয়মিত ওষুধ দেওয়াসহ দেখাশুনা করছেন। তবে রাজধানীর অন্যান্য অনেক হাসপাতালেই রোগীদের হাসপাতালের পক্ষ থেকে দেওয়া মশারি ব্যবহার না করতে দেখা গেলেও এখানে রোগীদের মশারির নিচেই সার্বক্ষণিক অবস্থান করতে দেখা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের নার্স ছাড়াও স্বাস্থ্যকর্মীরা এ নিয়ে প্রতিনিয়ত রোগীদের বুঝিয়ে থাকেন। তবে এরপরও কিছু রোগী মশারি খুলে রাখেন। যদিও সংবাদকর্মী বা চিকিৎসক আসার আগেই সবাইকে মশারি টানাতে বাধ্য করা হয় বলেও তথ্য মিলেছে। তবে সবমিলিয়ে অল্প কয়েকজন ছাড়া প্রায় সব রোগীই মশারি ব্যবহার করেন বলে জানা গেছে।Special-Reportএদিকে, ডেঙ্গু রোগীদের সেবা নিয়ে হাসপাতালটিতে বহুলাংশে সন্তুষ্টি থাকলে অভিযোগও রয়েছে রোগীর স্বজনদের।

রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম (ছদ্মনাম) গত দুই দিন ধরে স্ত্রীকে নিয়ে ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে অবস্থান করছেন। সেবার মানের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, এই হাসপাতালে সেবার মান ভালো। চিকিৎসকরা নিয়মিত রোগী দেখে যাচ্ছেন। তবে নার্স সংকট রয়েছে। পুরো ওয়ার্ডে মাত্র দুইজন নার্স। রোগীর তুলনায় সংখ্যাটি খুবই কম। তারা এত রোগীকে সেবা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। ফলে কখনো কখনো প্রয়োজনে তাদের পাওয়া যায় না।

ডেঙ্গু পরীক্ষায় দীর্ঘসময় অপেক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে একাধিক পরীক্ষার প্রয়োজন পরে। হাসপাতালটিতে এসব পরীক্ষার জন্য স্লিপ কাটার প্রক্রিয়াটি হাতে হাতে হওয়ায় এবং দায়িত্বরতদের দক্ষতার ঘাটতিতে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় শুধু স্লিপ কাটতেই ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট চলে যায়। যা রোগীর স্বজনদের জন্য একটি বড় ভোগান্তির বিষয়।Special-Reportরোগীদের এসব অভিযোগ ছাড়াও হাসপাতালের সক্ষমতার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান বলেন, গত শনিবার (১৫ জুলাই) সকাল ৮টা পর্যন্ত আমাদের এখানে রোগী ছিল ১১১ জন। রাত ৯টা পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৮ জনে।

হাসপাতালটি ১ হাজার শয্যার হলেও বর্তমানে সকল শয্যায় রোগী ভর্তি করার সক্ষমতা নেই। তবে আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। আশা করছি তা দুই-একদিনের মধ্যে পূরণ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে আমাদের চিকিৎসক ও নার্স পদায়ন করা হচ্ছে। এই জনবলগুলো যোগ হলে আমরা হাসপাতালটিকে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ বেড পর্যন্ত করতে পারব।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান বলেন, গত ১২ জুলাই ডিএনসিসি হাসপাতালটিকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এরপরই আমাদের এখানে লোকবল নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে এটি একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি প্রসেস। হাসপাতালে চিকিৎসক পদায়নের বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনস্থ। অপরদিকে নার্স পদায়নের বিষয়টি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের অধীনে। ফলে বিষয়গুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমরা আশা করছি অতি শিগগিরই পর্যাপ্ত জনবল পেয়ে যাব। সে ক্ষেত্রে নার্স সংকটের যে বিষয়টি রয়েছে সেটি সমাধান হয়ে যাবে।

৫ বছরের কম বয়সী শিশু ভর্তি না করার অভিযোগ

ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা শুরুর পর থেকে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ভর্তি না করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এমন হেনস্তার শিকার এক রোগীর স্বজন লালবাগের বাসিন্দা আজগর আলী। গত তিন দিন থেকে স্ত্রী লামিয়া এবং তিন বছরের ছেলে সজল জ্বরে আক্রান্ত। সবশেষ বেসরকারি ক্লিনিকে পরীক্ষার পর দুইজনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। পরে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ছুটে আসেন ডিএনসিসির কোভিড হাসপাতালে। এরপর চিকিৎসক তাদের দুইজনের শারীরিক অবস্থা এবং রিপোর্ট দেখে ভর্তি হতে বলে।

তবে স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলেও ছেলেকে ভর্তি করতে পারেননি আজগর আলী। কারণ, হাসপাতালে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ডেঙ্গু চিকিৎসা নেই। পরে স্ত্রীর ভর্তির সকল আয়োজন সম্পন্ন হলেও তাকে ভর্তি না করিয়েই চলে যান তিনি।Special-Reportহতাশা এবং ক্ষোভ জানিয়ে আজগর আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা স্বাস্থ্য কিংবা চিকিৎসা ব্যবস্থা হতে পারে না। কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছেন এ হাসপাতালটি ডেঙ্গু রোগীদের জন্য। এ সময় এখানে বিশেষ সেবা দেবে। কিন্তু তা তো দিচ্ছে না। বাবুর মাকে এখানে ভর্তি করানো যাবে বললেও বাবুকে বলছেন এখানে ভর্তি নিবে না। এটা কখনো সম্ভব? আমি একা মানুষ কয়দিকে দৌড়াব? মা এক জায়গায়, বাচ্চা আরেক জায়গায়।’

ভোগান্তির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর প্রথমে গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে সিট খালি নেই, পরামর্শ দিয়েছেন এখানে নিয়ে আসতে। এখানে এসে জানলাম বাচ্চার বয়স কম হওয়ায় তাদের কিছু করার নেই। মাথায় কিছু কাজ করছে না। দেখি কুর্মিটোলা পারি কি না, না হলে বেসরকারি কোনো হাসপাতালে বাবু এবং বাবুর মাকে ভর্তি করাব।’

রোগীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালের পরিচালক বলেন, আমাদের এখানে শিশু ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না, তা সঠিক নয়। আমাদের এখানে অনেক শিশুই ভর্তি রয়েছে। তবে পাঁচ বছরের নিচের বাচ্চাদের আমাদের এখানে ভর্তি করার বিষয়ে ডিসকারেজ করছি। আমরা তাদের শিশু হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পরামর্শ দেই। কিন্তু কোথাও সিট না পেয়ে যদি এখানে চলেই আসে, সে ক্ষেত্রে আমরা তাদের ফেরাই না।Special-Reportএর কারণ ব্যাখ্যা করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফিকুর রহমান বলেন, এটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল ছিল।

আমাদের এখানে অবকাঠামো করোনা রোগীদের অনুযায়ী তৈরি করা ছিল। করোনা এবং ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। করোনার জন্য অক্সিজেন নিশ্চিত করায় আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল। তখন আমাদের সকল ধরনের প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। লক্ষ্য করা যাচ্ছে ডেঙ্গুতে বাচ্চারাই বেশি আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণ করছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফিকুর রহমান বলেন, একদম ছোট বাচ্চা এবং বড়দের চিকিৎসা এক নয়। তাদের জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থার এবং বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়। যেটা বর্তমানে আমাদের এখানে নেই। এমনকি ৫ বছরের নিচের একটি শিশুকে একটা কেনোলা করতেও অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন হয়।

আমাদের এখানে এ ধরনের জনবলের ঘাটতি রয়েছে। তবে আমরা চাহিদার কথা জানিয়েছি। আশা করি দ্রুতই তা পেয়ে যাব এবং সকল বয়সী রোগীকেই আমরা চিকিৎসা দিতে পারব।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top